
বর্তমানে মানুষের মাঝে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ হচ্ছে, ডিপ্রেশন (মেজর ডিপ্রাইভ ডিসঅর্ডার)। এটি একটি গুরুতর মানসিক অসুস্থতা যা অনুভূতি, ভাবনা এবং দৈনন্দিন কাজকে প্রভাবিত করে। সৌভাগ্যক্রমে,
এর চিকিৎসা সম্ভব। ডিপ্রেশন আপনার স্বাভাবিক অনুভূতির ক্ষতি করে এবং কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। ডিপ্রেশনের কারণে বিভিন্ন ধরনের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা হতে পারে এবং ভূক্তভোগীর ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়িতে কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলি হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে এবং এতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেঃ
• মন মেজাজ সবসময় অকারনেই খারাপ থাকা।
• কোনো ভাল জিনিস যা আগে উপভোগ করতেন, তা করার ইচ্ছা চলে যাওয়া।
• ক্ষুধা পরিবর্তন - ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি।
• প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম বা বেশী ঘুমানো।
• শক্তি হ্রাস বা ক্লান্তি বৃদ্ধি।
• ধীরে ধীরে কথা বলা কমিয়ে ফেলা এবং অপ্রয়োজনেও হাত পা অনেক বেশী নাড়ানো।
• নিজেকে মূল্যহীন বা দোষী মনে করা।
• চিন্তা করতে, মনোযোগ দিতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধা।
• মৃত্যু বা আত্মহত্যার চিন্তা করা।
লক্ষণগুলি কমপক্ষে দুই সপ্তাহ স্থায়ী থাকতে হবে।
এছাড়াও, থাইরয়েড সমস্যা, মস্তিষ্কের টিউমার ইত্যাদি রোগের চিকিৎসারত অবস্থায় কিংবা ভিটামিনের অভাবে সাময়িকভাবে ডিপ্রেশন হতে পারে তাই ডিপ্রেশনের চিকিৎসা শুরু করার আগে অন্য সব চিকিৎসার খোঁজ নিয়ে নিতে হবে।
প্রতি বছর প্রতি পনেরো জনের মাঝে অন্তত একজন এবং প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন তাদের জীবদ্দশায় কিছু সময়ের জন্য হলেও ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে। ডিপ্রেশন যেকোনো সময়েই হতে পারে তবে বিশেষত টিনএজ থেকে শুরু করে ২৫/২৬ বছর পর্যন্ত ব্যাক্তির ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী। পুরুষদের চেয়ে নারীদের ডিপ্রেশন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে এক তৃতীয়াংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় একটি বড়রকমের ডিপ্রেশনে ভোগে।
ডিপেশন ও সাধারণ মন খারাপে অনেক পার্থক্য।
প্রিয়জনের মৃত্যু, চাকরি হারানো বা কোনো সম্পর্কের অবসান হওয়া যেকোনো ব্যক্তির জন্যই সহ্য করা কঠিন। এই পরিস্থিতিতে বিষাদ্গ্রস্থ হওয়াই স্বাভাবিক এবং এ সকল পরিস্থিতির সম্মুখীন ব্যাক্তি প্রায়ই নিজেকে ডিপ্রেসড বলে দাবী করতে পারে।
কিন্তু বিষাদগ্রস্থতা এবং ডিপ্রেশন এক নয়। বিষাদগ্রস্থতা একটি প্রাকৃতিক অনুভূতি যার সাথে ডিপ্রেশনের অনেক মিল রয়েছে কিন্তু এই দু’টি বিষয় একেবারেই ভিন্ন।
প্রথমত,
বিষাদের সাথে অনেক সময় অনেক ভাল স্মৃতি মিশ্রিত থাকে কিন্তু ডিপ্রেশনে অন্তত ২ সপ্তাহের
জন্য শুধু বিষাদই থাকে।
দ্বিতীয়ত,
ডিপ্রেশনে থাকলে নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে যা বিষাদগ্রস্থ
হলে হয় না।
তৃতীয়ত, কিছু মানুষের জন্য, প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।
চাকরি হারানো বা শারীরিক কোনো অক্ষমতা বা একটি বড় দুর্যোগের শিকার হওয়া কিছু মানুষের
জন্য ডিপ্রেশন সৃষ্টি করতে পারে। যখন বিষাদ এবং ডিপ্রেশন একত্রে বিদ্যমান থাকে,
তখন বিষাদ আরও গুরুতর হয় এবং বিষাদ স্বাভাবিকের চেয়ে
দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও হুট করেই ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে। যে বিষয়গুলো এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সেগুলো হচ্ছেঃ
১. বায়োকেমিস্ট্রিঃ মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট রাসায়নিকে সৃষ্ট কোনোরকমের পার্থক্য ডিপ্রেশনের
লক্ষণগুলিতে অবদান রাখতে পারে।
২. জেনেটিক্সঃ ডিপ্রেশন জিনগত। উদাহরণস্বরূপ, যদি দুইজনের টুইন ভাইয়ের একজনের ডিপ্রেশন থাকে,
তবে অন্যেরও তা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে ৭০%।
৩. ব্যক্তিত্বঃ নিম্ন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা,
যারা সহজেই চাপের দ্বারা হতাশ হয়,
বা সাধারণত হতাশাগ্রস্থ থাকে, তাদের ডিপ্রেশনে ভোগার
সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করা হয়।
৪.পরিবেশগত কারণঃ ক্রমাগত সহিংসতা, অবহেলা, অপব্যবহার বা দারিদ্র্য একটা মানুষকে ডিপ্রেশনের জন্য যথেষ্ট
দুর্বল করে তুলতে পারে।
ডিপ্রেশন দূরীকরণে প্রচলিত চিকিৎসাসমূহঃ
মানসিক অসুস্থতার সবচেয়ে বেশী সহজলভ্য হচ্ছে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা। ৮০-৯০ শতাংশ
রোগীই এতে সম্পূর্ণ আরোগ্যো লাভ করে।
চিকিৎসার আগে অবশ্যই একজন পেশাদার ব্যাক্তির সাথে কথা বলে কিছু শারীরিক
পরীক্ষা সহ অন্যান্য বিষয়ের কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা উচিত।
ডিপ্রেশন এড়াতে চিকিৎসক এ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট দিতে পারে যা প্রথম ২ সপ্তাহের
মাঝে হালকা কাজ শুরু করলেও রাতারাতি কোনো ফল দিবে না তাই রোগীর এসব ঔষধ অন্তত ৬
মাস নিতে হবে। কয়েক সপ্তাহের মাঝে কোনো ব্যাতিক্রম না দেখলে চিকিৎসককে জানাতে হবে।
ঔষধ ছাড়াও কাউন্সেলিং ভা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হতে পারে।
এছাড়াও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীর জন্য রয়েছে ইসিটি নামক এক থেরাপি যাতে
রোগীর অজ্ঞানাবস্থায় বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশনের ব্যাবহার করা হয়।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যাক্তির যা করণীয়ঃ
ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলি হ্রাস করতে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। অনেক মানুষের
জন্য,
নিয়মিত ব্যায়াম ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করতে এবং মেজাজ
উন্নত করতে সহায়তা করে। নিয়মিত পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম,
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং অ্যালকোহল জাতীয় যেকোনো পানীয়
এড়ানো ডিপ্রেশনের উপসর্গগুলি হ্রাস করতে সাহায্য করে।
হতাশা একটি মানসিক অসুস্থতা যআর প্রতিকার সম্ভব। যথাযথ উপসর্গ নির্ণয় করে
ঠিকমত চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ রোগীই এটিকে
পরাস্ত করতে পারবে। আপনি ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোর সম্মুখীন হন এবং
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আপনার পারিবারিক চিকিৎসক বা মনোরোগ
বিশেষজ্ঞর কাছে যান। আপনার উদ্বেগ সম্পর্কে আলোচনা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করুন।
ডিপ্রেশনের কারণে অন্যান্য যে যে অসুখ হতে পারেঃ
১. Peripartum Depression
২. Seasonal Depression
৩.Persistent depressive disorder (previously dysthymia)
৪. Premenstrual dysphoric disorder
৫. Disruptive mood dysregulation disorder
৬. Bipolar Disorder
তথ্যসূত্র
American Psychiatric
Association. Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders
(DSM-5), Fifth edition. 2013.
National Institute of
Mental Health. (Data from 2013 National Survey on Drug Use and Health.) www.nimh.nih.gov/health/statistics/prevalence/major-depression-among-adults.shtml
Kessler, RC, et al.
Lifetime Prevalence and Age-of-Onset Distributions of DSM-IV Disorders in the
National Comorbidity Survey Replication. Arch Gen Psychiatry.
2005;62(6):593602. http://archpsyc.jamanetwork.com/article.aspx?articleid=208678