
স্তন ক্যান্সার মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের পরেই মহিলাদের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। তাই স্তন ক্যান্সার সচেতনতার এই অক্টোবর মাসে আমাদের আজকের এ আয়োজন।
স্তন ক্যান্সার কীঃ
যখন স্তনে অস্বাভাবিক ভাবে কোষের বৃদ্ধি হয় তখন তা চাকা বা পিন্ডের মত হয়ে ব্রেস্ট টিউমার বা স্তন ক্যানসারে রূপ নেয়। স্তনের টিউমার সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে একটি হচ্ছে বিনাইন আরেকটি ম্যালিগন্যান্ট। বিনাইন টিউমার কোন ভয়ের বিষয় নয়। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট টিউমার খুবই ভয়ানক কারণ এটিই হচ্ছে স্তনের ক্যান্সার যা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে আক্রমণ করে।
উৎপত্তি
স্তনের দুধবাহী নালীতে ক্যান্সার এর উৎপত্তি। যখন চাকা বা পিন্ডের আকৃতি ধারন করে তখনই প্রথম ধরা পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে বড় হয় এবং বগলের নিচেও ছড়িয়ে পড়ে।
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায় একটি হলো অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি যার উপর আমাদের কোনো হাত নেই আরেকটি হল পরিবর্তনীয় ঝুঁকি যা নির্ভর করে আমাদের জীবনযাপনের উপর।
অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি সমূহের মধ্যে রয়েছে-
- নারী বা পুরুষ যে কেউই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে তবে সারা বিশ্বে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এবং এ রোগে মৃত্যুর হার সব থেকে বেশি।
- বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশেষ করে পঞ্চাশ বছর বয়সের পর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য যেমন BRCA1 ও BRCA2 জিনের মিউটেশন এর কারনেও পাঁচ থেকে দশ শতাংশ স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকে।
- বংশগত কারণে হতে পারে
- যেসব নারীদের বারো বছর বয়সে মাসিক শুরু হয় এবং পঞ্চাশ বছর বয়সের পর বন্ধ হয় তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
- শরীরে দীর্ঘদিন যাবৎ অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন হরমোন থাকলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
পরিবর্তনীয় ঝুঁকিসমূহ
- ত্রিশ বছর বয়সের পর সন্তান ধারন করলে, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে কিংবা নিঃসন্তান নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
- সবজি ও ফলজাতীয় খাবার কম খেলে এবং চর্বিজাতীয় ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার বেশি খেলে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন এবং শারীরিক পরিশ্রমবিহীন জীবন যাপন ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ।
- তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে আসলে স্তন ক্যান্সার হতে পারে।
লক্ষণঃ
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ বুঝতে হলে আপনার স্তন সাধারণত দেখতে কেমন এবং আপনি কেমন বোধ করে থাকেন সুস্থ অবস্থায় তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ নির্ণয় করতে পারলে পুরোপুরি সেরে ওঠা সম্ভব।
স্তন ক্যান্সারের সম্ভাব্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- স্তনে চাকা বা পিন্ড তৈরী হয়। কখনো কখনো সমস্ত স্তনে ফোলাভাব (এমনকি কোনও পৃথক পিন্ড অনুভূত না হলেও)।
- ত্বকে জ্বালা বা ডিম্পলিং (কখনও কখনও কমলার খোসার মতো দেখায়, ত্বকে খসখসে হয়ে যায়), স্তনবৃন্ত ও তার আশেপাশের কালো অংশে ফুঁসকুড়িসহ চুলকানি ।
- স্তনে ব্যথা ও আকার পরিবর্তন।
- স্তনের বোটা ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া, অসমান বা বাঁকা হয়ে যাওয়া।
- স্তনবৃন্ত হতে দুধের মত জলীয় দ্রবণ নিঃসরণ হওয়া (বুকের দুধ ব্যতীত অর্থাৎ আপনি ব্রেস্টফিডিং না করলেও)।
স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের পদ্ধতি
দুইভাবে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। স্ক্রিনিং আর রোগ নির্ণয়। স্ক্রীনিং নিজে নিজেও করা যায় আবার একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা করানো যায়। স্ক্রিনিং এর দ্বারা প্রাথমিক ভাবেই বুঝতে পারা যায় যে ভবিষ্যতে আপনার স্তন ক্যান্সার হবার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কিনা অথবা আপনি ইতিমধ্যে আক্রান্ত কিনা।
নিজে নিজে শনাক্তকরণ পদ্ধতিঃ
প্রতিমাসে পিরিওড সেরে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যে একবার করে এ পরীক্ষা করা যায়। কারণ, এসময় ব্যথা কম হয়। যাদের মেনোপজ হয়েছে তারা মাসের যেকোনো নির্দিষ্ট দিন সুবিধামতন বেছে নিন।
- আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যাপ্ত আলোর মাঝে দুইবাহু দেহের দুইপাশে ঝুলিয়ে দাঁড়ান। এবার দুইবাহু মাথার উপরে বা পেছনে উচিয়ে ধরুন। দুইহাত কোমরে চেপে দাঁড়ান। হালকা করে স্তনবৃন্ত চেপে দেখুন কোন রস এবং রক্ত বের হয় কিনা। লক্ষ্য করুন-স্তনের আকার, আকৃতি ও রং এর পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, স্তনের ত্বকের কোনো পরিবর্তন যেমন- ফুসকুড়ি বা পুরু কমলার খোসার মত আছে কিনা, স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে কিনা। এ লক্ষণগুলো মিলে গেলে বুঝতে হবে স্তন ক্যান্সার হয়েছে।
- স্পর্শ পদ্ধতিঃ দুই অবস্থানে (বিছানায় শুয়ে এবং গোসলের সময়) এ পরীক্ষাটি দুইবার করতে হবে। বিছানায় শুয়ে ডান স্তন পরীক্ষা করার সময় ডান কাঁধের নিচে ছোট বালিশ বা তোয়ালে ভাঁজ করে দিতে হবে যাতে বুক ও স্তন একই সমান্তরালে থাকে। তেমনিভাবে বাম স্তন পরীক্ষার সময়ও কাঁধের নিচে বালিশ বা তোয়ালে ব্যবহার করতে হবে। আবার, গোসলের সময় হাতে সাবান মেখে একই পরীক্ষা করতে হবে। ডান স্তন পরীক্ষা করার সময় ডান হাত মাথার উপর রেখে বাম হাত ব্যবহার করতে হবে এবং বাম স্তনের ক্ষেত্রে বাম হাত মাথার উপরে রেখে ডান হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা আঙ্গুলের স্পর্শে সহজেই বুঝতে পারবেন। প্রথমে একটু হালকা চাপ দিয়ে, পরবর্তীতে আরও ভারী চাপ এবং তৃতীয় পর্যায়ে বেশ জোরে চাপ দিয়ে স্তন টিস্যু সম্বলিত পুরো এলাকা পরীক্ষা করতে হবে।
চিকিৎসক দ্বারা স্ক্রিনিংঃ বিশ বছরের বয়সের পর থেকে প্রতি তিন বছরে একবার এবং চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি বছরে একবার পরীক্ষা করানো উচিত একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতিঃ স্ক্রিনিংয়ে যদি চিকিৎসক আপনাকে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি সম্পন্ন মনে করেন তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের রোগ নির্ণয় পদ্ধতি যেমন ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি এবং এবং এমআরআই ম্যামোগ্রাফি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তাই স্তন ও এর চারপাশে যে কোনো অসঙ্গতি মনে হওয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন এটি কোন লজ্জার বিষয় নয়। সুস্থতা প্রতিটি নারীর অধিকার।